DEHLIJ

অনিন্দ্য সান্যাল

ব্রেইলবর্ণ ধামাকা

অনিন্দ্য সান্যাল




এই অন্তহীন স্রোত, এই অন্তহীন সাঁতার, প্রাণকণিকার ভবিতব্য, একে ভয়াবহ ভাবলে ভয়াবহ, আনন্দস্বরূপ ভাবলে পরম তাই, একটু একটু আধ্যাত্মিক পরশ মাখিয়ে ভোম্বলানন্দে মগ্ন হয়ে এ-ও কয়ে দেওয়া যায়, এ উপলব্ধি সহজে হওয়ার নয়, যে নুনের পুতুল সমুদ্র মাপতে গিয়ে ফিরে না আসে ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন সাঁতরাতে সাঁতরাতে কতো মানুষজন ; ঢেউয়ের মাথায় মাথায় মাঝে মাঝে মাথাগুলো বলের মতন জেগে ওঠে, আমাদের বারো হাত কাঁকুড় নিঝুমে শুধু বেড়ে যেতে থাকে চেতনার অগোচরে, আমরা বাস্তবিক দেখতে পাই, স্বপ্ন বা কল্পনা দর্শন যখন, তখন দৃশ্য থাকে। মাথাগুলো জলে ওলোট পালোট, চোখ ফিরলে ক্ষণিকের শিহরণ, হিম স্রোত, যখন সেই মাথাগুলির মানুষ এখন বেঁচে নেই,। ঢেউয়ের ধাক্কায় মাথা আবার অন্য দিকে ঘুরে যাবার আগেই সমস্ত শিহরণ এবং বিমূঢ়তা কাটিয়ে চিৎকার করে বলি, চিনতে পারছেন ? মাথা থেকে চোখদুটো ছিটকে বেরিয়েই জলের ওপর খানিক থেমে থাকল, না, ঠিক, হ্যাঁ, মানে …… মনে করাতে চেষ্টা করি, বইমেলায়, অজিতদা করিয়ে দিলেন, আলাপ,  তারপর খানিক আড্ডা হলো, মনে না পড়া স্বাভাবিক অবশ্য। চোখদুটো আবার মাথার খোঁদলে ঢুকে যেতেই ঢেউয়ের ধাক্কায় মাথাটা খানিক দূরে ছিটকে গেল। অন্য আর একটা মাথা কাছাকাছি কথা বলে উঠল, ওর মনে নেই বোধহয়, আচ্ছা দাঁড়াও আমিই ওকে মনে পড়াচ্ছি। সেই মাথা অন্য মাথাকে ডাকলো তখন, বাতাসে কথাগুলো মিহি হয়ে ভেসে বেড়াতে থাকে; এই সব প্রাণকণিকার ভবিতব্য, এইসব সমুদ্র এবং মাথাগুলি আমাদের চেতনায় আজও হিম হয়ে রয়ে গেছে। সেইসব ডাক, মনে পড়ানো, আলাপ করানো পুনর্বার …… ঝিম রাত্রে এই সমস্ত আলাপ খুব আলতো স্বরে মাঝে মাঝে জানলার পর্দা সরিয়ে ঢুকে পড়ে।  কিন্তু “ মেরা ভেজা বাওলা ন করে”, আলাপ না ঘেঁটে দেয় আপাতত বাকবিস্তার। 

শাব্দিক জগত দিয়ে আমরা পরিব্যাপ্ত, কবি কি ভাষার বাইরে বাস করেন ? কোনো ‘শীতরাত্রি ক্রমে ঘন হয়ে ওঠে’ যখন আবারও দেখা হয় কবির সাথে, কবি আমাকে দেখে থতমত, আমার শরীরের চারিদিকে যেসব শব্দেরা আমাকে ঘিরে রাখে, তাদের স্পর্শ করে করে তিনি আমাতে পৌঁছতে চান, নাকি তিনি তা চান না আদৌ, আল্টিমেটলি তিনি তাঁর নিজের শব্দগুলির রঙ গন্ধ  ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে দেখতে থাকেন, আর আমাদের চতুর্দিকে ঘিরে থাকা শব্দদের আকাশ, পৃথিবী ও জলের সংস্পর্শে নিয়ে আসতে থাকেন। তাঁর মনন যেমন শব্দ ধরার ফাঁদ তেমনি শব্দও ক্রমাগত বয়ে চলা বাস্তব জগতের দ্রুতিকে ধরে স্লথ করে দেওয়ার এক ফাঁদ। সেই জড়তায় স্থিতিজাড্য নিষিক্ত করে যে কবিতা তা-তে দ্রুতির খুরের শব্দ নিহিত থাকে। দীপঙ্কর দত্ত-র কবিতা-র ভূমিকায় অজিত রায় লিখেছিলেন, ‘ আরও এক যে-গুণে দীপঙ্করের কবিতা আমাদের খিঁচে রাখে তার নাম গতি।‘  আর আমার কখনো মনে হয় বিষাক্ত। বিষহরি কখনো না। ব্রেইলবর্ণ ?    

মোমকাঠি ওঠানামা করে, মোমকাঠির ওঠানামা, ষাঁড় ভালুকের লড়াই, এইভাবে যখন নটা – সাড়ে তিনটে হাত মারা,  কীভাবে ‘বীজের উচ্ছ্বাস আসার ঠিক আগের মুহূর্তে’ নিজেকে শেয়ার বাজার থেকে সরিয়ে নেওয়া যায় ? শব্দই ক্রিয়া। শব্দকে এমন নিষ্ঠুর পরীক্ষায় সেঁকে নিয়েই তো তার নির্যাস ‘কুয়াশার ডাবিং-এ ভোর ফাটছে / আর হাওয়ার চাবুক উছলে উঠছে হিলহিলে রেল জ্যা / লেত্তির হ্যাঁচকা টানে  লেলিয়ে দেওয়া ঘূর্ণি ট্রাম / এবার ছুটে আসছে আমার দিকে / আমি সসারগুলো এভাবে ছুঁড়ছি যাতে / হাওয়া ঝড়ে টার্ন নেয় আর সমস্ত ধুন্দ / বায়ুকোণ থেকে অগ্নিতে খেদিয়ে / নিরেট এককাট্টা করে ঐ ট্রামের সামনে …

শব্দ কি কোনো উপাদান, যেমন চিত্রকরের রং যা সে ক্যানভাসে ছুঁইয়ে নির্মাণ করে তার নিজস্ব বিশ্ব ? আমরা যখন কথা বলি, শব্দসমূহ তখন সেই রং বা কাঠমিস্ত্রীর কাঠ ছেনি হাতুড়ি। কথা বলা অন্তে, বক্তব্য শেষ হলে তার দায়িত্বও ফুরিয়ে যায়। কিন্তু কবির সাথে শব্দের সংঘাত তার সৃষ্টির আদিমমুহূর্তেই, যখন ঘন ঘন নিশ্বাস ও ফোরপ্লেও শুরু হবে কি না তার নিশ্চয়তা দৃঢ় হয়নি। আর কবির নির্বাচিত বা কবির কাছে ধরা পড়ে যাওয়া শব্দ বা কবিকে ধরে ফেলা শব্দ সেই শব্দ যে বস্তুকে চিহ্নিত করে সেই শব্দ সে বস্তুকে ছাপিয়েও আরো কিছু যেন হয়ে উঠতে চায়। কিন্তু কবি কি সজ্ঞানেই শব্দকে নির্বাচন করেননি ? শব্দের শাব্দিক ঐশ্বর্য, তার ল্যাজা মুড়োর মাপ, তার পুং ও স্ত্রী অনুগামিতা, যে-ভাবে তার অন্ত্যাক্ষর সূচিত, তার সৌন্দর্য, সব কিছু মিলে একজন কবির কাছে চিহ্ন দাবী করার বদলে উপস্থাপনা হয়ে ওঠে, উপস্থাপনা রক্তমাংসেই যেন, ভার্চুয়াল না হয়। শব্দ রক্তমাংসের বা বস্তুর গঠনপ্রাপ্ত হয়ে কবিতায় সে শব্দ এমন চিত্রকল্পের জন্ম দিতে পারে যা-কে দীপঙ্কর শেয়ার মার্কেটের ভাষায় মাল্টিব্যাগার বলতেই পারেন, পেশাসূত্রে। সে চিত্রে বর্ণিত বস্তুনিচয়ে সেই শব্দের সঠিক ক্রিয়াস্বরূপচিহ্নিত বস্তুর কোনো অনুষঙ্গ খুঁজে পাওয়া যায় না অনেক সময়। শব্দ বহুমাত্রিক এবং বহুস্তরিক হয়ে ওঠে।    

অজিত রায় তাঁর ভূমিকায় বলেছিলেন, দীপঙ্করের শব্দব্যবহার বিষয়ে, শব্দের “ অসীমায়িত ও বিবিধ-ভারতীয় শব্দের ঝুরি”।  

অনেকদিন আগের ঘটনা, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এসে ঢুকলেন নন্দনচত্বরে বাংলা অ্যাকাডেমির সভাঘরে, একটি পত্রিকার আহবানে এসেছিলেন বক্তব্য রাখতে। সেই বক্তব্যের টুকরো টাকরা মনে পড়ে। বক্তব্যের শুরুতেই নীরেন্দ্রনাথ, এই সভায় আসার সময় রাস্তায় নাকি একটা বিজ্ঞাপন দেখেছেন এবং সেখানে লেখা আছে বিশাল ধামাকা অফার। তিনি, নীরেন্দ্রনাথ মুখ বেঁকিয়ে বলেছিলেন, এটা কোন শব্দ, ধামাকা ! এটা বাংলা না হিন্দি ? কথা হলো, ভাষাকে কোন অবস্থান থেকে ঘোমটা পরানোর প্রয়াস শুরু করার কথা অনেকে ভাবেন বা ভাবতেন ? কতটা তার চৌহদ্দি যার বাইরে অন্য ভাষার সাথে তার লদকালদকি বারণ ? এখনো পর্যন্ত যে-সকল শব্দ আমরা ব্যবহার করি তার অনেক শব্দই তো ইতিউতি চু কিত কিত খেলে লব্ধ ।

 তাহলে আমি কি নিজেও এই ধামাকা শব্দটি ব্যবহার করি, লেখায় এবং কথা বলার সময় ? না তো ! আমার কথাভ্যাসে আসেনি, কিন্তু আমার চারপাশের বহু মানুষের কথাভ্যাসে শব্দটির আকছার ব্যবহার। শুধু ধামাকা না, ঢের এমন শব্দ আমাদের প্রতিনিয়ত ঝেলতে হবে। আর এখন মনে হয় এমন শব্দ লেখার প্রয়োজন হলে আমি তাকে রুখবো না। কিছু বিশেষ বিশেষ শব্দ তার নিজের জোরেই অন্য ভাষায় নিজেকে ছড়িয়ে দেয়। তার রাজনৈতিক এবং আর্থ সামাজিক কারণও থাকে, থাকেই। ধামাকা শব্দটি সম্ভবত এই রকমই এক শব্দ। বাঙালি যা দেখে ফ্রীজ, টিভি কিনতে ছোটে, শপিং মলে একটা টুথপেস্টের সাথে আরেকটা ঝোলায় রাখে। হয়তো বিজ্ঞাপন থেকে আসা শব্দ, বাঙালি দেখল। কিন্তু নন্দনচত্বরের কোনো বাকসভা আর মাসিক পত্রের কয়েক গোছা কবিতা এই ধরণের অনেক শব্দকে বাঙালির মৌখিক শব্দভাণ্ডার থেকে সরিয়ে রাখতে পারেনি। যখন দেখি আমার নিজের পরিবারের ছোটোরা বাংলার থেকে ইংরিজিতে বেশী সাবলীল, যখন দেখি তারা অনেকেই দল বেঁধে চলে যায় বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ, তখন তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে তাদের নিজের মাতৃভাষা নিজস্ব সহজাত শব্দের মিশেলে বলতে দেওয়াতেই বোধহয় মঙ্গল। তখন ছানাশাবকের মাধ্যমে বাংলাভাষার বিবর্তন ; ভাষা যেহেতু প্রদেশাবদ্ধ না।       

ধর্মযুদ্ধের সময় নাইটরা যখন যুদ্ধে বেরোতো তখন স্ত্রীদের নাকি চেস্টিটি বেল্ট পরিয়ে রেখে যেত। সে ছিল এক শেকলবিশেষ, যা কোমরে পরে থাকতে হতো স্ত্রীদের, তার জাঙ্গিয়ার মতন অংশটি চেপে রাখত যোনির মুখ, শধুমাত্র হিসু করা যেত, কোনো পুরুষাঙ্গ বা পুরুষাঙ্গসদৃশ কোনো বস্তু প্রবিষ্ট করানো যেত না। সতীবন্ধনীর ইতিহাসে নানারকম অনুমানের মধ্যে একটি এমত। এখন অবশ্য বি ডি এস এম সূত্রে সতীবন্ধনীর নানান প্রয়োগ প্রযোজ্য। এখন কথা হলো, বাংলা ভাষাকে সেরকম বেল্ট পরিয়ে রাখার নেপথ্যে অনেকেরই কিছু সাধ ছিল বা হয়তো পরিচিত শব্দভাণ্ডারের বাইরে কোনো শব্দ দেখলে গায়ে চাকা চাকা দাগ বেরোতো, কিন্তু তেমনটি কোনো ভাষাতেই বোধহয় সম্ভব না। বাংলাতে যেভাবে আরবি ফারসি শব্দ মিশেছে, ইংরিজি মিশেছে তেমনি অন্য ভাষার শব্দও তার নিজস্ব দম্ভে বা কোনো সময়কালীন চাহিদায় মিশবেই। এর ওপর আর্থ সামাজিক কারণও বর্তায়। ইংরিজিতে যেমন লাঠিচার্জ ঢুকে পড়ে অবলীলায় বাংলাতেও এমন অনেক  শব্দ প্রতিনিয়ত ঢুকছে এবং বেরোচ্ছে, হাওড়া লিলুয়া খেলার মতো। কোনো কোনো শব্দ হাওড়া থেকে আর বেরোয় না, থেকে যায়। আমাদের ছোটোবেলার পোঁদগুলি বড়ো হয়ে গাঁড় হয়ে যায়। এবং যে কোনো ভাষার যত  জারজতা, বা আরো ভালোভাবে ব্যক্ত করলে যত বহুগামীতা, ছেনাল প্রবৃত্তি, তত তার সমৃদ্ধি, তত তার অন্দরমহলে শব্দপ্রাচুর্য, তত অভিজ্ঞতা এবং তার প্রকাশসিদ্ধতা। দেখা যাক, কবি কীভাবে শব্দ আহবান করেন । 

দীপঙ্কর দত্ত কবিতার মুখবন্ধে অজিত লিখেছিলেন, ‘ দীপঙ্করকে ‘ডায়াস্পোরিক’ বলা হচ্ছে মূল বঙ্গভূম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দীর্ঘদিন লাগাতার দিল্লিতে বসবাস করছেন সে-কারণেই কেবল নয়। ডায়াস্পোরিক মানুষের জীবনধারা ও মতিগতির ……………… যেমন রবিকে করেছেন রভি, ব্রাহ্মণকে ব্রাহমন, মা-বোনকে মা-বহ্যান। …………………………… ডায়াস্পোরিক কবি-লেখকদের চর্চার বেলায় একটা কথা মানতেই হবে – হয় নিজের অভিজ্ঞতায় নয় অভিজ্ঞদের গল্প শুনে, এঁরা বাংলা সহ গোটা ভারতবর্ষকে অনেক বেশি চেনেন ; এঁদের যে ভূগোল ও নৃতত্বের জ্ঞান এবং অনিবার্য ভাবে এঁদের রচনাকর্মে জবরদস্ত মোহর দেখা যায় আর, তা বছরঘুরনি কলকাতার চুনোপুটিমার্কা মার্কোপোলোদের চেয়ে ঢের বেশি দুরস্ত। ফলত এসব ডায়াস্পোরিক কবি-লেখকদের শব্দের বাচ্চাদানিও তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট ফাঁপানো, অর্থাৎ ভরাট।  ‘ 


এইভাবে শব্দের ধামাকা হয়, আগ্নেয় বসন্তের জাগলার জেগে ওঠে। ঢেউ ওঠে, ঢেউ ভাঙে, মাথাগুলো পিংপং বলের মতন ভাসতে থাকে, বিগত সময়ের কবির তালিকায়, গদ্যলেখকের তালিকায়  জেগে ওঠা নামগুলো লাল নীল বল হয়ে ঢেউয়ের ধাক্কায় কখনো কাছে আসে, কখনো দূরে সরে যায়, তখন সান্নাটা জেগে ওঠে। …… নরক জ্যোৎস্না ঢেকেছে জ্যাবড়া জ্যাবড়া ঘোর পিঙ্গল মেঘ তবু পাথর ও রাত্রির এই ডিউরিপ্যাট্রিক লুতাশ্লেষ্মার ঘুম লুঠেলজিভে দিগ্ধা গান গায়      রোমহীন হাউণ্ড লোহিত ঘেয়ো যোনি উগরে যায় শিশু স্বপ্ন প্রেম   এসো, বাইরে এসো          


তারপর, তারপর, অ্যাম  সরি         জানি একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে, কিন্তু স্যার, উস্কানিটা আমি এভাবেই দেই এবং দেবো কারণ আঘাৎ বলতে বুঝি  Death blow, Coup de grace.  বাড়িতে হানা দিন, মা-ঝি ফেঁড়ে যান, বাবাকে থাপ্পড়      রাস্তায় ম্যাটাডর থেঁৎলে যা এক পা দুসরা পায়ে অপাহিজ দেওতা-অন্নদাতা এবং জিঘাংসা দুই কষে হিঁচড়ে ট্রেলপথে হাঁকাবো পৃথিবী খুদগন্ধী কুয়াশার ব্রা-য়ের আড়ালে ছ্যাঁচামাই আঁতুড় পিঁচুটি পেট্রল জবজবে শিশু            

টোকা মেরে জ্বলন্ত কাঠি ছুঁড়ে ফেলি -  



No comments

FACEBOOK COMMENT