DEHLIJ

নলিনাক্ষ ভট্টাচার্য

ঠগির সৌজন্যে

নলিনাক্ষ ভট্টাচার্য



রমেনদাকে চাকরির কথা বললে সিগারেটে টান দিয়ে তুড়ি মেরে বলল, ‘হয়ে যাবে, চিন্তা করিসনা। কলকাতা থেকে আসা বেকার ছেলেদের আমি সব রকমে সাহায্য করি। মেডিকাল রিপ্রেসেন্টেটিভের কাজ করতে পারবিতো?’

আমি মাথা চুলকে বললাম, ‘ ও কাজতো কখনো করিনি রমেনদা।’

‘ তিন মাসের ট্রেণিং দেওয়া হবে, সব শিখে যাবি।’

আমি হেসে বললাম, ‘ তবে আর চিন্তা কি? ঠিক করে নেব।’

‘ একদিন বাড়ি আসিস। সেক্টর নয়, তিনশো তেষট্টি নম্বর। এ ব্যাপারে ডিটেলস-এ কথা বলা যাবে।’

১৯৬৮ সালে বিএসসি পাশ করে তিন বছর অনেক চেষ্টা করেও কলকাতায় চাকরি জোটাতে না পেড়ে শেষ পর্যন্ত এক পিসতুতো দাদার কাছ থেকে দিল্লিতে চাকরি পাবার সম্ভাবনা শুনে ছ’মাস হল আর কে পুরমের সাত সেক্টরে দাদার আশ্রয়ে এসে উঠেছি। দাদা বিত্ত মন্ত্রালয়ে এল ডিসি, সাইকেল করে অফিসে যান, কিন্তু পার্ট টাইম পুরুতের কাজ করেন সেই সুবাদে দু’চারজন হোমরা চোমড়া গোছের লোকের সঙ্গে আলাপ আছে দাদার। ওই ভরসাতেই আমাকে দিল্লি আসতে বলেছিলেন দাদা আর কালকা মেলের টিকিট কাটবার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন পঞ্চাশটি টাকা মনি অর্ডার করে। কিন্তু সাইকেলের পিছনে বসিয়ে দাদা আমাকে সেইসব বড়লোক যজমানদের বাড়িতে যখন নিয়ে গেলেন চাকরি জোগার করার উদ্দেশ্যে, সবাই ‘দেখছি’ ‘দেখব’ কিংবা ‘ইউপিএসসির ক্লার্ক গ্রেডের পরীক্ষায় বসে যাও’ এরকম উপদেশ দিয়ে আমাদের বিদায় করলেন। অগত্যা কী করি, দাদার পরিচিত সেক্টর চার-এ এক বাঙালি ভদ্রলোকের অতি দুরন্ত ছেলের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হলাম। পাঁচদিন পড়িয়ে পঁচিশ টাকা পাই। সিগারেটের খরচ আর নানা জায়গায় চাকরির জন্য দরখাস্ত পাঠাবার ডাক খরচ কোনমতে উঠে আসে ওই টাকায়। সন্ধ্যার দিকে বাড়ির কাছেই দক্ষিণ দিল্লি কালীবাড়ির লাইব্রেরি রুমে গিয়ে চাকরির বিজ্ঞাপন দেখতে খবরের কাগজের পাতা ওল্টাই আর মন্দিরে গিয়ে মাথা ঠুকি মায়ের কাছে চাকরির প্রার্থনা করে। 

তা ওই মন্দিরে মাথা ঠুকতে গিয়েই আলাপ হল রমেনদার সঙ্গে। সারাভাই কেমিকালস-এ মেডিকাল সুপারভাইজারের চাকরি নিয়ে কলকাতা থেকে বদলি হয়ে রমেনদা দিল্লি এসেছে গত বছর। সঙ্গে আছে ওর স্ত্রী আর এক বাচ্চা ছেলে। থাকে আমার ঠিল ছোঁড়া দূরত্বে, সেক্টর নাইনে। ফর্সা রঙ, টিকোলো নাক, মুখে স্মিত হাসি, বড় চাকরি করে আর আলাপ হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমার করুণ কাহিনি শুনে চাকরি দেবার প্রতিশ্রুতি দিল রমেনদা। নাঃ পৃথিবিতে ভাল উপকারী লোকের সংখ্যা কম হতে পারে, কিন্তু আছে নইলে প্রথম আলাপেই বাড়িতে দেখা করার আমন্ত্রণ জানাতনা রমেনদা।

এক রোববার সকালে সেক্টর ন’তে রমেনদার বাড়িতে চলে এলাম। রমেনদার স্ত্রী শ্রীলতা বৌদি খুব সুন্দরি, ফর্সা গোলগাল চেহারা। সিনেমা সিরিয়ালে অভিনয় করেন যে অপরাজিতা আঢ্য তার ট্রু কপি বলা চলে। দেড় বছরের বাচ্চাটাও খুব সুন্দর। বৌদি চায়ের সঙ্গে কলকাতার নলেন গুড়ের সন্দেশ খাওয়াল আমাকে। কথায় কথায় বেরিয়ে পড়ল বৌদি আমার দ্যাশের মাইয়া – তার বাপমার দেশ ছিল বরিশাল। বৌদি বলল, ‘ শোন নলিন, তুই আমার দেশের ছেলে, বৌদি টৌদি নয়, আমাকে তুই দিদি বলবি।’

আমি আনন্দে গদ গদ হয়ে বললাম, ‘ ঠিক আছে দিদি।’ বাচ্চাটার জন্য দুটো লজেঞ্চুস  আনলে হত, মনে হল আমার।

‘ আর শোন প্রত্যেক রোববার সকালে এখানে এসে আমাদের সঙ্গেই জলখাবার খাবি তুই, কেমন?’

আমি একটু আমতা আমতা করে বললাম, ‘ তা কি করে হয় দিদি, পিসতুতো দাদার সঙ্গে থাকি, রোববার ওনার সঙ্গে টুকিটাকি কাজ করতে হয় আমাকে। গম পেষানো, রেশন আনা এগুলোতো রোববারেই করি দাদার সঙ্গে গিয়ে।’

‘ কেন তোর দাদার ছেলে নেই?’

‘ না, দাদার তিন মেয়ে, সবকটাই খুব ছোট, দশের নীচে।’

‘ ওহো, তাহল অন্তত অল্টারনেট রোববারগুলোতে চলে আসবি এখানে, কেমন?’

আমি নিজের অজান্তেই মাথা হেলিয়ে দিলাম।

চলে আসার সময় রমেনদা আমার সঙ্গে নীচতলায় এসে বলল, ‘ তোর নতুন পাতানো দিদির সঙ্গে অনেক ভ্যাজর ভ্যাজর করলি, এবার কাজের কথা শোন। তোর চাকরির কথা তুলেছি অফিসে। ওখানে এ্যাডমিনে যারা বসে আছে সব ঘাঘু মাল, টাকা না ছাড়লে ওরা কিছু করবেনা। দুশো চাইছিল, আমি বলে কয়ে একশোতে নাবিয়েছি। কাল সকালে অফিসে যাবার আগে তোর বাড়িতে আসব, টাকাটা আমাকে দিয়ে দিবি।’

আমি মাথায় হাত দিলাম। ‘ এত টাকা? আমিতো পঁচিশ টাকা পাই টিউশনি করে।’

‘ তোর দাদার কাছ থেকে চেয়ে নে। এক মাসের মধ্যে চাকরি হয়ে যাবে তোর, মাইনে হবে তিনশো টাকা। প্রথম মাসের মাইনে পেলে দাদাকে টাকা ফেরত দিয়ে দিবি।’

আমি যে আশা নিয়ে রমেনদার বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলাম সেটা সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারলামনা। সব শুনে দাদা বললেন, ‘ নারে টাকা দিয়ে চাকরি পাবার দরকার নেই। আমার কী রকম গোলমলে ব্যাপার মনে হচ্ছে। তুই বরঞ্চ ক্লার্ক গ্রেডের পরীক্ষার জন্য ফর্ম ভরে দে, পাশ করলে এক বছরের মধ্যে সরকারি চাকরি পেয়ে যাবি।’

বৌদি বললেন, ‘ একবছরতো অনেক সময়, এতদিন ও বসে থাকবে কেন? একশো টাকা দিয়ে যদি চাকরি হয় মন্দ কি? রমেন কাছেইতো থাকে, সংসারও আছে ওর। টাকা নিয়ে ভেগে যেতে পারবেনা।’

পরের দিন সকালে প্যান্ট কোট টাই পরিহিত রমেনদা চলে এল আমাদের ছোট দুই কামরার সরকারি কোয়ার্টারে। দাদা ততক্ষণে অফিসে চলে গেছেন আর আমার ভাইঝিরা শ্যামাপ্রসাদ বিদ্যলয়ের বাসে উঠে গেছে। বৌদির সঙ্গেই দু’মিনিট কথা বলল রমেনদা আর বৌদিও মুগ্ধ হয়ে গেলেন রমেনদার মিস্টি ব্যবহারে। ‘ দেখবেন ভাই আমার দেওরের চাকরিটা যেন হয়ে যায়,’ বৌদি বললেন জলের সঙ্গে দাদার পুজোয় পাওয়া বর্ফি রমেনদার হাতে তুলে দিয়ে।

‘ আপনি একদম চিন্তা করবেননা বৌদি,’ রমেনদা বলল বর্ফিটা মুখে ফেলে। ‘ ওর দায়িত্ব আমি নিয়েছি আর আমার বউতো বরিশালের মেয়ে।’

‘ ওমা তাই নাকি? তাহলেতো ভালই হল, একদিন বউকে নিয়ে আসবেন আমাদের এখানে।’


কিন্তু দেখতে দেখতে দু’মাস কেটে গেল, চাকরির কোন ব্যবস্থা করলনা রমেনদা। সেই ‘হচ্ছে হবে’, ‘ম্যানেজার এখন টুরে আছে, ফিরলেই কথা পাড়ব’ . . .ইত্যাদি। ওদিকে শ্রীলতা বৌদি আমার সঙ্গে ভাই সম্পর্ক পাতিয়ে ফায়দা তুলে নিচ্ছে যখন তখন। রোববার রমেনদার বাড়ি গেলে বৌদি বুবুনকে আমার কোলে তুলে দিয়ে দু’জনে নিশ্চিন্তে চলে যায় বাড়ির কাছেই সঙ্গম সিনেমাতে নতুন রিলিজ হওয়া হিন্দি ছবি দেখতে। ঝুমঝুমি টুমটুমি খেলনা দিয়ে কতক্ষণ ভোলানো যায় দেড় বছরের দুরন্ত বাচ্চাকে? ঘণ্টা খানেক পরেই ‘ম্যা ম্যা’ করে চেঁচাতে শুরু করে বুবুন। তখন ওকে নিয়ে আমাকে সামনের পার্কে ঘোরাতে নিয়ে যেতে হয়। কখনো মুখে লজেঞ্চুস পুরে থামাতে হয় ওর কান্না আর কোনরকম ওয়ার্ণিং না দিয়েই আমার কোলে হিসু করে দেয় ও।

রমেনদার বাড়িতে আর যাবনা ঠিক করেও যেতে হয় শুধু এই কারণে যে আমার একশোটা টাকা ওখানে বাঁধা পড়ে আছে। আমি ওখানে নিয়মিত গেলে চাকরি না পাই অন্তত টাকাটাতো উদ্ধার করা যাবে। একদিন ঠিক করলাম অনেকদিন অপেক্ষা করেছি, এবার আমার পাতানো দিদিকে একটু কথা শুনিয়ে আসব। রোববার গেলে রমেনদা বাড়িতে থাকবে, তাই এক শুক্রবার দুপুর বারোটা নাগাদ হানা দিলাম রমেনদার বাড়িতে। বৌদি তখন মাংস রান্না করছিল, আমাকে দেখে খুশি হয়ে বলল, ‘ বুবুনের সঙ্গে একটু খেলা কর নলিন, তোকে চিকেন খাওয়াব আজ।’ মাংসের গন্ধে আমার জিভে জল এসে গেল কিন্তু কিন্তু আমি মন শক্ত করলাম।  ‘তোমার সঙ্গে একটা জরুরি কথা আছে দিদি,’ বললাম আমি। 

‘ প্রেশারে মাংসটা বসিয়ে দিয়ে আসছি দাঁড়া,’ বলল বৌদি।

একটু পরে প্রেশারে হুস হুস শব্দ উঠল, শাড়িতে হাত মুছতে মুছতে বৌদি এসে বলল,  ‘অসময়ে এসেছিস যখন তুই বুঝেছি বিশেষ কথা আছে আমার সঙ্গে।’

‘ দিদি, তুমি আমার দেশের মানুষ কিন্তু রমেনদা আমাকে দু’মাস ধরে ঘোরাচ্ছে। যদি চাকরি না দিতে পারে টাকাটাতো তুমি ওকে বলে ফেরত দিতে পার। দাদার আর্থিক অবস্থাও বিশেষ ভালনা, বুঝতেই পাচ্ছ . . .’ বলতে বলতে আমার চোখে হঠাৎ জল এসে গেল।

শ্রীলতা বৌদি এবার সোফায় আমার পাশে এসে বসল, তারপর আমার কাঁধে হাত রেখে বলল,  ‘তোকে আর লুকোবনা নলিন, সব কথা খুলেই বলি। তোর রমেনদা যে একটা ঠগ সেটা বিয়ের আগে বুঝিনি। ও যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত আমার দাদার সঙ্গে আর সেই সুযোগে আমার অঙ্কের টিউটর হয়ে গেল। পড়াশুনায় ভাল ছিল ও কিন্তু ভালবাসা এমন জিনিষ যে সব বুদ্ধি সুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ একদিন কালীঘাটে আমাকে নিয়ে গিয়ে  মাথায় সিঁদুর পড়িয়ে দিল, তারপর ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে সারাভাই-তে জয়েন করল। সেসবতো ঠিক ছিল। তারপর ছেলে হল আর বদলি হল দিল্লিতে। ছ’ মাস পর ওর চাকরিটা চলে গেল। সেই থেকে ও চাকরি দেবার বাহানায় কলকাতা থেকে আসা বেকার ছেলেদের কাছ থেকে টাকা নেয়। আর এইভাবেই আমাদের সংসার চলে। দু’একটা ছেলেকে ওর পুরনো অফিসে কাউকে ঘুষ দিয়ে তিন ছ’মাসের জন্য লাগিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম তোকেও অন্তত ছ’মাসের জন্য যদি চাকরির ব্যবস্থা করে রমেন তবে ওই একশো টাকা তোর জলে যাবেনা। এই বাচ্চাটা না থাকলে কবে আমি ওকে ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে যেতাম রে।’  শ্রীলতা বৌদি এবার ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল, আমি ছোটভাই পকেট থেকে রুমাল বের করে দিদির চোখের জল মোছাতে লাগলাম।

একটু পরে আমার জন্য একটা বাটিতে দু পিস চিকেন এনে দিল বউদি। বলল, ‘ নে খা, দেখি কী করতে পারি তোর জন্য। আর পারলে আমাকে মাফ করে দিস ভাই। ওর কাছ থেকে কক্ষনো টাকা ফেরত পাবিনা তুই, তাই মাঝে মাঝে এসে আমার কাছ থেকে দশ বিশ টাকা করে নিয়ে যাবি। এভাবেই শোধ করব আমি তোর টাকাটা।’ আলমারি খুলে তক্ষুণি বিশ টাকা আমার হাতে তুলে দিল শ্রীলতা বৌদি।

 আমি বললাম, ‘ না না দিদি তুমি কেন . . .’

‘ দিদির মুখের উপর কথা বলবিনা তুই। আর শোন, এখন থেকে রোববার এসে চাকরির জন্য তোর রমেনদাকে তোষামোদ করতে হবেনা।’

 

মার্চ মাসের শেষের দিকে ইউপিএসসির এসিস্টান্ট গ্রেডের ফর্ম ভরে জমা দিলাম আর পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করে দিলাম। রমেনদা যে ঠগ সে কথা আমার দাদা-বৌদিকে জানালামনা আর শ্রীলতা বৌদির কাছ থেকে টাকা আনতেও ও বাড়িতে আমি গেলাম না। দেখতে দেখতে তিন মাস কেটে গেল, জুন মাসে এসিস্টান্ট গ্রেডের পরীক্ষা হয়ে গেল। পরীক্ষার পড়া ভাল ভাবে করার জন্য সেই পঁচিশ টাকার টিউশনিটা ছেড়ে দিয়েছিলাম, এবার সেক্টর বারোতে একটা পঞ্চাশ টাকার টিউশনি পেলাম। ক্লাস এইটের ছেলে, সপ্তাহে তিন দিন শুধু অঙ্ক করাই। চা সিগারেটের পয়সার জন্য আর দাদার কাছে হাত পাততে হয়না।

জুলাই মাসের এক সকালে হঠাৎ রমেনদা এসে হাজির। বলল, ‘ চল, তোর একটা চাকরির ব্যবস্থা করেছি আমি।’

আমি বললাম, ‘ না রমেনদা, আমি প্রাইভেট চাকরি কোরবনা।’

রমেনদা বলল, ‘ সরকারি চাকরিই দেব তোকে।’

আমি বুঝলাম রমেনদা আবার আমাকে ধাপ্পা দিয়ে শ’খানেক টাকা পকেটে পুরতে চায়।

‘ থাক, রমেনদা, আমি এসিস্টান্ট গ্রেডের পরীক্ষা দিয়েছি। রেজাল্ট যতদিন না বেরোয় টিউশনি করে চালিয়ে নিতে পারব।’

বৌদি বললেন, ‘ যাওনা ঠাকুরপো বলছে যখন। সাধা লক্ষ্মী পায়ে ফেলতে নেই।’   

আমি কী করে বৌদিকে বলি যে এ লোকটা ঠগ, ও শুধু টাকার জন্য এসেছে। আমি বললাম,  ‘রমেনদা আমি কিন্তু আর কোন টাকা দিতে পারবনা তোমাকে।’

রমেনদা হেসে বলল, ‘ তোর কাছে টাকা চাইতে আসিনি আমি। চল আমার সঙ্গে।’

ব্যাজার মুখে শার্ট প্যান্ট পরে আমি বেরিয়ে এলাম রমেনদার সঙ্গে। রমেনদা একটা অটো ডেকে ড্রাইভারকে বলল, ‘ এইম্‌স জানা হ্যায়।’ 

অটোতে যেতে যেতেই রমেনদা জিজ্ঞেস করল আমাকে, ‘ প্রুফ রিডিং জানিস তুই?’

আমি বললাম, ‘ একটু একটু জানি। কলকাতায় থাকতে পত্র-পত্রিকায় লিখতাম, কখনো কখনো প্রুফ রিড করতে হত। এ টি দেবের ডিক্সনারির পেছনে প্রুফ রিডিং-এর নমুনা দেওয়া আছে, ওটা দেখে কাজ চালিয়ে দিতাম।’

‘ ঠিক আছে। যেখানে তোকে নিয়ে যাচ্ছি, জিজ্ঞেস করলে বলবি কলকাতায় বাংলা কাগজে তুই প্রুফ রিডারের কাজ করেছিস। চাকরির জন্য একটু মিথ্যে কথা বললে দোষ হয়না।’

রমেনদা আমাকে নিয়ে চলে এল ডক্টর আর পি সেন্টার ফর অপথালমিক সায়েন্স-এর দোতলায়। করিডোরের শেষ প্রান্তে পিআরও নির্মল সিং-এর কামরায় ঢুকলাম আমরা।

‘ স্যর, হিয়ার ইজ দ্য বয় আই টোল্ড ইউ এবাউট,’ রমেনদা বলল সর্দার নির্মল সিং-কে।

নির্মল সিং একবার আমার দিকে তাকালেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘ ডু ইউ নো প্রুফ রিডিং?’

‘ ইয়েস স্যার,’ বললাম কাঁচুমাচু মুখ করে। 

‘ হি হ্যাজ ওয়র্কড এ্যাজ আ প্রুফ রিডার ইন আ ক্যালকাটা নিউজ পেপার ফর থ্রি মান্থস,’ রমেনদা বলল আমার হয়ে।

‘ ঠিক আছে। চেয়ারে বোস, আমি তোমার টেস্ট নেব,’ বললেন নির্মল সিং। আমরা দু’জন চেয়ারে বসলে একটা কাগজ আর পেন আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে নির্মল সিং আমাকে গোটা পাঁচেক কমন প্রুফ রিডিং-এর সিম্বল লিখতে বললেন যার মধ্যে চারটা আমি ঠিক লিখতে পারলাম। 

‘ ওকে, আই উইল টেক হিম,’ আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন নির্মল সিং।

‘ আমি কবে জয়েন করব স্যার?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘ ইউ ক্যান স্টার্ট রাইট নাও। আমরা এখান থেকে একটা জার্নাল বের করি যার নাম ওরিয়েন্টাল আর্কাইভস অফ অপথালমোলজি। ওটার প্রুফ দেখতে হবে তোমাকে। তুমি একটা এপ্লিকেশন লিখে দাও এক্ষুণি, আমি ওটা আমাদের ডাইরেক্টরকে দিয়ে এপ্রুভ করিয়ে নেব।’

আমি জানালাম আমি পরের দিন থেকে কাজে লাগব। 

সিনেমা সিরিয়ালে যেভাবে নায়কের চাকরি হয় তার থেকেও দ্রুত এবং আশ্চর্যজনকভাবে আমার চাকরি হল এইম্‌স-এ যদিও ওটা ছিল ক্যাজুয়াল প্রুফ রিডারের চাকরি। মাইনে ইউডিসির, তিনশো দশ টাকা। ফিরবার পথে রমেনদাকে আমি জিজ্ঞেস না করে পারলামনা এই রকেট গতিতে আমার চাকরিটা কীভাবে হয়ে গেল। রমেনদা জানাল যার রেকমেন্ডেশনে আমার চাকরিটা হল তার নাম প্রতুল গুপ্ত। তিনি দিল্লির স্টেট্‌সম্যান কাগজের সিনিয়ার প্রুফ রিডার আর নির্মল সিং প্রিন্টিং লাইনের সব কাজ একসময় ওঁর কাছ থেকেই শিখেছিলেন। শুধু তাই নয়, প্রতুল গুপ্ত ভাল হাত দেখতে জানেন আর নির্মল সিং-এর হাত দেখে যা যা বলেছিলেন প্রতুল গুপ্ত তার বেশির ভাগ ফলে গেছে, কাজেই ওঁকে গুরুর সন্মান দেন নির্মল সিং। রমেনদা নিজের হাত দেখাতেই গিয়েছিল প্রতুল গুপ্তর কাছে আর সেখান থেকেই এই কাজের সন্ধান পেয়েছিল।


রোববার সকালে অনেকদিন পর কাজু বর্ফি নিয়ে আমি গেলাম রমেনদার বাড়ি। শ্রীলতা বৌদি আমাকে এতদিন আসিনি বলে দু’চার কথা শোনাল, তারপর রমেনদাকে শিঙারা আনতে বাইরে পাঠিয়ে আমাকে বলল, ‘ রমেন আমার ধাতানি খেয়ে তোকে মেডিকাল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি দেবার জন্য দু’মাস আগেই তোর বাড়ি যাচ্ছিল, আমিই ওকে আটকে দিয়েছি। আমি বলেছি ‘ আমার ভাইকে তোমার ওই তিন ছ’মাসের জন্য ঘাবলার চাকরি দিলে চলবেনা। পারলে ওকে ভাল চাকরি দাও নইলে নয়। ঠাকুরের ইচ্ছায় তোর ঠিক জায়গায় চাকরিটা হয়ে গেল নলিন।’

আমি ঢিপ করে শ্রীলতা বৌদিকে একটা পেন্নাম করে বসলাম।

বৌদি এবার আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘ আমরা আর এখানে বেশি দিন থাকতে পারবনা রে। ও এখানে এত ধার কর্জ করে ফেলেছে আর এত বেকার ছেলেকে ঠকিয়েছে যে কী বলব তোকে . . . তুই এসেছিস খুব ভাল করেছিস। দিদিকে ভুলে যাবিনাতো?’

আমি শুধু মাথা ঝাঁকালাম, কিছু বলতে পারলামনা কারণ আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল।  

 সেদিন অনেকটা সময় কাটালাম আমি রমেনদাদের সঙ্গে, বুবুনের সঙ্গে খেলা করলাম অনেকক্ষণ। কী জানি আমার মন বলছিল ওদের সঙ্গে আমার আর দেখা হবেনা।


দু’সপ্তাহ পরে একদিন অফিস থেকে ফিরে এলে বৌদি বলল, ‘ তোমার রমেনদা এত বড় ঠগ জোচ্চোর ছিল জানতামনাতো। কাল রাতে ও পরিবার নিয়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। পুলিশ ওর খোঁজ করছে। তোমার চাকরিটা আবার এই ধাক্কায় চলে যাবেনাতো?’

আমি মাথায় হাত দিয়ে বললাম, ‘ কী জানি বৌদি, কপালে কী আছে আমার।’ 

কিন্তু ঠগির সৌজন্যে পাওয়া সেই প্রুফ রিডারের চাকরিটা থেকে আমাকে বিতাড়িত করা হয়নি, বরঞ্চ এক বছর পরে ইউপিএসসি-র এসিস্টান্ট গ্রেড-এর পরীক্ষা পাশ করে আমি যখন ওটা ছেড়ে দিয়েছিলাম নির্মল সিং একটু দুঃখ পেয়েছিলেন কারণ ওনার সঙ্গে আমার কাজের সম্পর্কটা খুব ভালই জমে উঠেছিল একবছরে। 


- - - 



 


         

 


 

   

   

  


1 comment:

  1. দক্ষিণ দিল্লী কালিবাড়িতে মায়ের কাছে মাথা ঠুকে বেকারত্ব ঘুচোনোর সুন্দর জীবনমুখী গল্পে শেষ পর্যন্ত কেউই ঠকতে পারে না। অসংখ্য ধন্যবাদ একটি বিশ্বাসযোগ্য স্মৃতিরোমন্হনের বর্ণনায়।

    ReplyDelete

FACEBOOK COMMENT