DEHLIJ

শুভ আঢ্য

নিজের সামনে নিজেকে দেখানোর ক্যামেরাম্যান 

শুভ আঢ্য



নস্টালজিয়া এক বিষম বস্তু, অনেকাংশে তা একটা ব্র্যাকেট! তা’র মধ্যে আমরা ভালো ভালো জিনিসই দেখি। বেসিক্যালি যা আমরা দেখতে চাই। যেমন বাঙালি দেখতে চায় দুপুরবেলা খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে, ঠা-ঠা রোদে হেঁটে যাচ্ছে আইসক্রিমওলা, সন্ধ্যেয় ‘বেইইইইল ফুল’ বলে হেঁকে যাচ্ছে কেউ, রাতে কড়াইয়ে গরম রসগোল্লা ছাড়ল ময়রা। সে এক সোনার দিন আছিল! আমাগো ক্ষেতের পর ক্ষেত ছিল, জমিজমা ছিল, পুকুরভরা মাছ ছিল। ছিল। আবার প্রত্যেকদিন পাওয়ার কাট ছিল, কলকারখানায় লক আউট ছিল, চাক্কা জ্যাম ছিল, মহামারী ছিল, দুর্ভিক্ষ ছিল। সব ছিল। আমরা ব্র্যাকেটের বাইরে রেখে দিই সে সব দৃশ্য, যা কিছু আমরা দেখতে চাই না। যদিও সেগুলো’ও ছিল, বা বলা ভালো জম্পেশ করেই ছিল। 


এখন এই সব জায়গায় আলো ফেললে তা বাঙালির মুখের ব্রণ’কে বা বে’বাড়ি যাবার সময় পাঞ্জাবির তলায় ফুটোওলা গেঞ্জি’কে বের করে আনার মতোই বিব্রতকর সত্য। সুতরাং তা নিমের পাঁচন। আরও খোলসা করে বললে, ভিলেন। দীপঙ্কর দত্ত তেমনই। বাংলা কবিতায় যখন ফুলের জোয়ার এসেছে, সান্ধভাষা থেকে রবীন্দ্রনাথ হয়ে অ্যাপ্রন বাঁচিয়ে সামান্য পরীক্ষা-নীরীক্ষা আর প্রমিত ভাষায় বিছানা গরম করা বিপ্লব হচ্ছে, দিকে দিকে পাঞ্জাবি আর শান্তিনিকেতনি শাড়ি পরে অফিসের রিক্রিয়েশন ক্লাবের প্রোগ্রামে অক্টেভ কাঁপিয়ে কবিতা আবৃত্তি হচ্ছে, সে সময়ে একটা কাঁটার মতো, অনেকে পচা শামুকও বলে থাকতে পারেন। যিনি যেতে ও আসতে কাটেন, আস্তে কাটেন না এবং কোনো ভাবেই তাঁকে শাঁখের করাতও বলা যায় না। করাতকলে তাঁর কবিতা তৈরি হয়। কাঠের গা’য়ে প্রয়োজনীয় অংশটি রেখে তার অপ্রয়োজনীয় অংশটি বাদ দিয়ে লেখা কবিতা, আর করাতকলের কান ফাটানো শব্দ। বড় ছটফটে, কালো, কোমরে ছেঁড়া-আধময়লা ইজের পরা প্রায় ন্যাংটো একটা বাচ্চা। মুখে সিকনি শুকিয়ে গেছে, চোখ পিংপং বলের মতো ঠিকরে আসছে, এমন একটা বাচ্চা। বিদেশিরা যেমন ভাবে এখনও ভারতকে চেনেন বা ইউনিসেফ থেকে ফাণ্ড আনতে যা প্রয়োজন। তাঁর কবিতার কোনো পদবী নেই, পেডিগ্রিও নেই সেই অর্থে, স্বয়ম্ভূ গোত্রের। 


এখন এই শীতকালে কবিতাপাঠ আর বইমেলা’র মিঠে মিঠে জয়নগরের মোয়া’র বাজারে ব্যাপারটা অনেকটা ঝলসানো মাংস’র মতো। মাইণ্ড ইট, ঝলসানো, রোস্টেড নয়। তা মহুয়া দিয়ে খাওয়া যায়, দিশি দিয়ে, তাড়ি দিয়ে খাওয়া যায়। যারা ও স্বাদ গ্রহণে অক্ষম, তাঁদের ড্রইংরুমে ওঁর এন্ট্রি নেই, উনি চানওনি এন্ট্রি কোনোদিন। 


এমন নয় যে দীপঙ্কর দত্তের আগে বাংলা কবিতা সাবালক ছিল না। তা কেবলই হাঁটি হাঁটি পা পা করেই চলত। অনেক আগেই এখানে মলয় রায়চৌধুরী, ফাল্গুনী রায়, অনন্য রায় খাপ খুলে গেছেন। কল্কি অবতারের মতো কাটতে কাটতে এগিয়ে গেছেন তাঁরাও। নতুন ভাষা দিয়েছেন, মুখের ভাষা, শ্লেষ্মার ভাষা, পুঁজ রক্ত বীর্যকে এনেছেন কবিতায়। একটা হিসেব-নিকেশ যে তখন থেকেই চালু হয়নি এমনও নয়। তবে যা হয় আর কি! সরকারি ব্যাঙ্কে একদিন গিয়ে সব কাজ হয়েছে বলে তা’র থেকে তো এই ইনফারেন্স ড্র করা যায় না, যে সরকারি ব্যাঙ্কটির পরিষেবা ভালো হয়ে গেছে, কারণ সেখানে পরের দিনই বা পরের কনজিকিউটিভ বেশ ক’টি দিন লিঙ্কই থাকবে না, দস্তুর এমনটাই। অনেকদিন চর্বি জমার পর কোনো এক শীতের সকালে দু’বন্ধু মর্নিং ওয়াক করেছে। তাজা হাওয়ার পর কালে মাথায় হিম পড়ে টেম্পরেচার বেড়ে যাওয়া বাঙালিদের জায়েজ। তা’তে যা হবার তা’ই। ফের ক’দিনের মতো জানলা বন্ধ, হনুমান টুপি। ফের চর্বি জমা শুরু। এখানেই দীপঙ্কর দত্ত আরেকটি আখড়ার নাম। কিটো ডায়েটের মতো, অলংকার-টলংকার খুলে কবিতায় শুধুমাত্র প্রয়োজনমতো নামমাত্র সুঠাম, চাবুক শব্দ বসানোর কারিগর।


ধরা যাক, একটা লাইব্রেরি। সেখানে কোনো আলো জ্বলছে না। কোনো চেয়ার টেবিল নেই। ‘সাইলেন্স প্লিজ’ বলে নোটিশও টাঙানো নেই। খালি তার থেকে অনেক দূরে একটা বিশাল বড় পাতিল। পাতিলের তলায় খড়ের আগুন। সে খড়ের আগুনের আলো লাইব্রেরি অব্দি পৌঁছাচ্ছেও না। সেখান থেকে একটার পর একটা শব্দ খুঁটে আনছেন দীপঙ্কর দত্ত। হাতে দস্তানা ও চপার। শব্দগুলোকে ডিসেকশন করছেন, ইমোশন ঢালছেন তা’তে যার রঙও অনেকাংশে কালো, এর ভেতর ইনজেক্ট করছেন তন্ত্র, কালাজাদু যা কিছু থেকে কবিতাকে দূরে রেখে রেখে এতদিনে অনেকটাই সখী বানিয়ে ফেলা গেছে। পাশাপাশি অন্ধকার হাতড়ে বের করে আনছেন খুলি বা হাড়। তাঁর গা উদোম। তাঁর গা’য়ে ডোমের গন্ধ। পোস্টমর্ডানইজমের আলোয় তাঁর মুখ খুব একটা ভালো দেখা যাচ্ছে না। তিনি ঘুরছেন, খুঁজছেন শুধু। মাঝে নাড়ি কেটে ভাসিয়ে দিচ্ছেন জলে। তবে যা পাচ্ছেন, ফেলছেন পাতিলে। সেখান থেকেই একটা সময় শব্দগুলো জুড়ে জুড়ে কবিতা হয়ে উঠবে। একটা সময় সেখান থেকেই জেগে উঠবে কালভৈরব।


কবিতায় জীবন নেই, জীবনের চেয়ে মৃত্যু’কে তিনি ভালবাসতেন। ভালবাসতেন জীবনানন্দ ও আরও অনেক কবিরাই। তবে তেমন মৃত্যু নয়। এ বড় কঠিন ঠাই। মৃত্যুর পরম মুখাখানি চেয়ে হৃদয় আকুলিবিকুলি করা বিরহ… এসব ধারণার বাইরে থার্ড ডিগ্রির পর জল চেয়ে না পেয়ে পুলিশ মর্গের ভেতর পড়ে থাকা লাশ। রেললাইনের সামনে ধড় মুণ্ডু আলাদা হয়ে যাওয়ার ভেতর থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে মৃত্যু, শব্দ ও কবিতা। আয়নার সামনে নিজের অণ্ডকোষের ছবি দেখতে দেখতে তা নিয়ে তুল্যমূল্য কাটাছেঁড়া করার আরাম, নিজেকে পারফেক্ট না দেখে থুতু ছোঁড়ার ছবি, খানিক অ্যাঁড় চুলকিয়ে পাজামার দড়ি ঠিক করে পাশ ফিরে শোওয়া নয়। অনেকটা বিনয় মজুমদার যে ভুট্টা সিরিজের জন্য অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত অনেকের কাছেই। অথচ তা ফ্যাক্ট ছাড়া আর কিছুই নয় বাকি অনেকের কাছে। 


তিনি হিরো হতে আসেননি। তাঁর বিরোধও ছিল না কোনো হিরোদের সাথে। তবে তিনি হিরোর পাশে নিছক ক্যারেক্টর আর্টিস্ট হতেও আসেননি। তিনি একক অঙ্ক! কালো ড্রপসিনের সামনে একটাই স্পটলাইট। আর স্পটলাইট হলেই তাঁর যে তেজ থেকতে হবে এমনটাও নয়, সামান্য স্তিমিত। পেছনে সাদা থানের মতো উড়ে যাচ্ছে চিতার ধোঁয়া। মুখ দেখানোর চেয়ে না দেখানোতেই বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। তিনি নিজের মতো করে সাজিয়েছেন সেট। প্রপসও তাঁর নিজস্ব। সেখানে কোনো প্রোটাগনিস্ট নেই। গল্প’কে নিজের দিক থেকে বলেছেন। ‘A villain is always a villain, if the hero tells the story.” তিনি তা’র পরোয়া না করে আউট অফ দ্য বক্স কথা বলেছেন। প্রচলিত অনেককিছুর মতো এসব কথা অনেকেই শুনতে চান না, শুনতে না চাইলে কারুকে কিছু শোনানো যায়ও না। তিনি জোর করে শোনানোর পক্ষপাতীও ছিলেন না। তিনি তাঁর দেখাকে ডকুমেন্টেড করে গেছেন জাস্ট। ওঁর লেখা বেসিক্যালি আরাম দেয় না, চড়কের মেলায় পিঠে আংটা গেঁথে যে শান্তি পাওয়া যেত, সেরকম শান্তির জন্য উনি লিখতেন। 


“এক্সকিউজ মি, একটা লাশ বয়ে এনেছিলাম একবার যদি এসে দ্যাখেন!

এক্সকিউজ মি একটা লাশ নিয়ে এসেছিলাম, কার যদি একটু দ্যাখেন!

এক্সকিউজ মি একটা লাশ জাস্ট দু’মিনিট সময় চাইছি…

রিগর মর্টিস সেট-ইন করছে একটা লাশ বাঞ্চোৎ কার এসে একবার দ্যাখ! 

চন্দাবেনের কোয়ার্টার থেকে টানতে টানতে এই অব্দি পিঠ বেঁকে গ্যাছে, কমসেকম

নিজের লাশটার দিকে একবার তো তাকান!” – দীপঙ্কর দত্ত


আমাদের সামনে আমাদেরকেই ফেলে দিয়েছেন তিনি। ব্র্যাকেটের ভেতর থেকে বের করে আমাদেরকে ফেলে দিয়েছেন ব্র্যাকেটের বাইরে যে জায়গাটা অনেক বড় ও শ্বাপদসঙ্কুল, সেখানে। স্পটলাইটের তলা থেকে আমাদেরকে ড্রপসিনের পেছনে নিয়ে দেখিয়েছেন, থার্ড বেল বাজার পরেও সবসময় নাটক শেষ হয় না, তা চলতেই থাকে। বেসিক্যালি কোনো কিছুই শেষ হয় না, যতটুকু দেখালে ‘তারপর সকলে সুখে ঘর-সংসার করতে লাগিল’ মার্কা এণ্ডিং করা যায় আমরা ততটুকু দেখে ও দেখিয়েই খুশি থাকি। আর আমাদের সামনে আমাদেরই দেখার আতঙ্কে আমরা তাঁর লেখা থেকে বার বার পালিয়ে বেরাই। এই আতঙ্ক এই কালোজাদু তাঁর লেখায় ভরপুর থেকে গেছে। অতএব ‘আন্ধেরা কায়েম রহে!’ নিজের সামনে নিজেকে দেখানোর ক্যামেরাম্যান, হয়তো একদিন আমরা নিজের সঙ্গে নিজে মহুয়া নিয়ে বসে ‘উল্লাস’ বলে উঠব, ওস্তাদ!!! 



1 comment:

FACEBOOK COMMENT