DEHLIJ

নন্দিতা সাহা

দুটি টাকা 

 নন্দিতা সাহা 



"এই   রবি  আমাকে দে ,  রবি আমাকে দে  , আমি আগে এসেছি  , রবি দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ,  রবি আমি কিন্তু সব ভেঙ্গে ফেলবো ,  রবি বেল বাজল বলে ,  রবি  আজ    যদি তোর জন্য বকা খাই  না  দিদিমণির  কাছে !! তারপর দেখবি তোর ঠেলা গাড়ির  টায়ার পাংচার করে দেব  ! " 

      এতগুলো ছোট ছোট অবুঝ  মেয়ের  দাপাদাপি রবির মুখের সামনে ,  তবু রবি অস্থির হয়না , অধৈর্য হয় না   |  সবাইকে যার যার পছন্দের জিনিস টি  দেয় |  মাত্র আধ ঘণ্টা  চলে এই তুমুল  হট্টগল | রবিকে  চারিদিক থেকে যেন ভিমরুলের মত ছেঁকে ধরে  !  তারপর বেলটা বাজলেই নিমেষে একেবারে খালি হয়ে যায় |   রবি তখন বটগাছের তলায় বসে জিরিয়ে নেয় |  আবার স্কুল ছুটির সময় কিছু বিক্রি-বাট্টা হবে খন  | 

" মা সারদা বালিকা বিদ্যালয় " |  তারই সামনে এক কোণে রবি ওর ঠেলাগাড়ি নিয়েই বসে থাকে |  কি নেই ওরা গাড়িতে  !  পাকা তেতুল  ! চালতার আচার  ! পপিন্স  !লেবেঞ্চুস  | ডালমুট  ! ঝাল মুড়ি  !  শোনপাপড়ি ! লেড়ে বিস্কুট !  সবকিছু   কাচের বয়ামে  সাজানো থাকে |  স্কুলের অল্প বয়সী মেয়ে গুলো ওকে  ছেঁকে ধরে  | কেউ  রবির হাত থেকেই পায় , কেউবা ছোঁ মেরে হাত থেকে নিয়ে চলে যায় কোনও রকমে পয়সাটা দিয়ে |  কেউ কেউ আবার চোখ পাকিয়ে বলে ,  রবি এত ঝাল কেন দিয়েছিস  !  রবি হাসি হাসি মুখ করে আবার বানিয়ে দেয়  | ওদের দুষ্টুমি  রবির  চোখ এড়ায় না |  বছরের পর বছর এই কাজই করছে রবি  |  ভালোই লাগে |  সংসারটাও চলে যায় |

      রবি নজর করেছে , একটি মেয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকে |  মনে হয় নতুন |  সবার থেকে একটু আলাদা  | চেহারায় ধনী ঘরের ছাপ  |  পরিষ্কার ধবধবে ইউনিফর্ম |  মেয়েটি  দুই একবার  বার চেষ্টা করেছিল ভিড়ের মধ্যে ঢোকার ,   কিন্তু এমন দাপুটে হাতের কাছে হার মেনেছে   |  ওর মুখে একটা লজ্জা লজ্জা ভাব  |  তেমন সহজ হতে পারে না  |  রবি বোঝে  মেয়েটা সবার থেকে অন্যরকম বৈকি |   মোটেই দামাল নয় ,  দস্যিপনা ওর কম্ম নয় |

          রবি নিজেই জিজ্ঞেস করে ,   দিদি তোমার কি চাই  ?  নীলা বলে দেয় |  রবি ওর কাগজের তিনকোনা ঠোঙায়  করে  গুছিয়ে  রেখে দেয় , তারপর সুযোগ বুঝে,  দিদি এই নাও বলে হাতে গুজে দেয় |  রবি জানে এই  শান্তশিষ্ট মেয়ে টি  ওই ডাকাবুকো মেয়েদের সাথে পেরে উঠবে না মোটে |   

 রবি 50 বছরের মাঝবয়সী  |  তবে কাঁচাপাকা  চুলে  বয়সটা অনেক বেশি দেখায় |   তবুও ওই কচিকাঁচারা সবাই রবিকে  তুই-তোকারি করে  | কারো দ্বিধা হয় না |  রবির তাতে কোনো আপত্তি নেই,  বেশ ভালোই  লাগে |  ও যেন ওদের বন্ধু হয়ে যায়  |  

কিন্তু নীলা  পারেনা |  ওর বাড়ির শিক্ষাদিক্ষা ওকে   সবার থেকে একটু  অন্যরকম বানিয়েছে |  মা বলে , বড়দের তুই-তোকারি করবি না সে যেই হোক না কেন  !  মুচি মেথর হলেও না |  যে বয়সে বড় তাকে সবসময় সম্মান করে কথা কইবে  |  নীলা  রবিকে , রবিদা বলে ডাকে | রবির  চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে  | মনটা ভরে যায়  | 

           মাঝে মাঝে রবির ছেলে  চুপটি  করে বসে  থাকত    রবির  পাশে | নীলাকে দেখে কইতো ,  ওই মাইয়া ডা  বড় লোকের বেটি   |  নীলার  বড় লজ্জা করে |   নিজেকে সবার থেকে আড়াল করে রাখত  |  একদিন অবশ্য   রবিকে দেখে নীলা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল |   রাগে  চোখ লাল  , কপালের শিরা ফুলে উঠছে , ছুটে গিয়েছে রবি  | এই সা  হাত টেনেছে ! হাত একেবারে মটকে  দিয়েছিল লোকটর |   লোকটা নাকি এমনি এমনি রবির ছেলেকে এক থাপ্পড় মেরেছিল |  ব্যাস  ! আর যায় কোথায় !  সত্যি সন্তানের জন্য বাবা কি না করতে পারে   !  রবি সব ভুলে গিয়ে লোকটার হাত কট করে মটকে দিল  |   একেবারে রিভেঞ্জ   !  রবির   সেই  রুদ্রমূর্তি এখনো নীলার  চোখে স্পষ্ট  |   বাপরে এত রাগ রবির !!    না দেখলে বুঝাই যায়না  , ভাবাই যায় না| 

 ,

            দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর আবার সেই স্কুলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে নীলা  |  স্কুল ছাড়ার পর কলেজ  | তারপর বিয়ে |   খুব শিগগিরই বিয়ে হয়ে গেছিল  | বরের হাত  ধরে দূরে ,  দূরে, অনেক দূরে চলে গিয়েছে |  এখানে,  সেই ছোটবেলার জায়গায় আর ফিরে আসা হয়নি | দুম  করেই বিয়েটা হয়ে গেল  | ইচ্ছে ছিল বিয়ের আগে একবার স্কুলে এসে ঘুরে যাবে কিন্তু তাড়াহুড়োয় সে আর  হয়ে  ওঠেনি |   বড়  দিদিমণি অবশ্য ওকে আশীর্বাদ জানিয়েছিল   |  লিখেছিলো,  " সারা পৃথিবীতে ডানা মেলে উড়ে বেড়াও,  খুব সুখী হও   | তোমার ঝকঝকে পরিষ্কার স্বচ্ছ মনটা যেন ঠিক একই রকম থাকে  | সত্য পথ ছেড়ো না  | " আজও সেই চিঠি যত্ন করে বিয়ের অ্যালবামে রেখে দিয়েছে নীলা | পঁচিশ  টি বছর পরে , এই ছোট্ট পাড়া গাঁ জন্মভূমিতে এসেছে নীলা | ইচ্ছে ছিল একবার স্কুলটাকে প্রণাম করে যাবে,  কারণ স্কুল নীলার  কাছে ঠিক যেন মন্দির , তীর্থক্ষেত্র | 


       মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে  নীলা |  ঝাঁ চকচক করছে ওর  "সারদা বালিকা বিদ্যালয়  " | স্কুল এখন তিনতলা হয়েছে  | চারিদিকে সাজান গোছানো গাছের সারি |  সামনে পেল্লাই গেট  | প্রাচীর  | আগে তো এতসব কিছু ছিল না  | বোঝাই যাচ্ছে স্কুলের অনেক উন্নতি হয়েছে , স্কুলের জৌলুস বেড়েছে  |   নীলা খবর পায় , এই স্কুল থেকে নাকি এখন বোর্ডে স্ট্যান্ড করে  !!   গর্বে মনটা ভরে যায় নীলার |

     মেয়েকে নিয়ে  ঢুকলো স্কুলে | সে ---- ই সেদিনের দিনগুলো চোখের সামনে ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে লাগল |  প্রথম যেদিন এসেছিল  ক্লাস সেভেন এ , সেদিন ছোট্ট একটি গেট দিয়ে ঢুকে ছিল |  স্কুলে ঢুকে  ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল  ! কেমন  হবে  দিদিমণিরা   !  ও তো নতুন এসেছে !!   ক্লাস এর মেয়েরা কেমন হবে !  আজ কিন্তু মোটেও ভয় নেই  নীলার  | আজ শুধু আনন্দ আর অদ্ভূত এক শিহরণ |  

           নীলা অফিস এ  জানাতেই ,  কেউ একজন গিয়ে হেডমিস্ট্রেস কে খবর দিলো  |  প্রাক্তন ছাত্রী এসেছে শুনে  হেডমিস্ট্রেস  নিজেই এগিয়ে এলেন |  সাদরে নিয়ে গেলেন ভেতরে  | ততক্ষণ প্রার্থনার জন্য  ছাত্রীরা তৈরি  | খুব ভালো সময়ে  এসেছে |  স্কুলের সেই মাঠ   ! সেই চৌকো মাঠ এখনো একই রকম আছে বরং জৌলুস যেন আরও বেড়েছে  | চারিদিকে সবুজ | মনে পড়ল  ওরা একবার পনরই আগস্ট এ বৃক্ষরোপণ  করেছিল | আহা সেই গাছ গুলোই  বুঝি বড় হয়ে স্কুল কে একেবারে সবুজে  ভরিয়ে দিয়েছে | 

    স্কুলের প্রত্যেকটি ছাত্রী মাঠে ঠিক সে --ই রকম লাইন করে দাঁড়িয়েছে  |  প্রার্থনার জন্য সবাই হাত জোড় করে আছে | |  সবার সাথে  নীলাও দাঁড়িয়ে পড়ল |  দুই হাত জোড় করে গাইল , "আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণও ধুলার পরে "| 

      নীলা র মনে পরল সেই সময় নীলার  সাথে থাকতো শ্রাবণী ,  দুর্গা , চুমকি , শুক্লা,  গার্গী,  মৈত্রী  , কেকা | সবাই একসাথে লাইন করে ক্লাস থেকে আসত |   ওরা ভারি  দুষ্টু ছিল  !!  কেউ গাইতো না  |  চোখ মিটমিট করত আর ঠোঁট দুটো একটু নাড়াত |   ক্লাস টিচার  কস্তূরী দি সব বুঝতে পারতেন  |  পেছন থেকে এসে মাথায় এক গাট্টা মারত |  সবাই একসাথে চেঁচিয়ে উঠতো  "আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণও ধুলার পরে  " | নীলাও বাদ যেত না |  তখন সবার সাথে শুরু করতো একই সুর | আজ অ্যার মাথায় গাট্টা দেবার কেউ নেই !! আজ নিজেই প্রাণভরে  গাইল |


 আজ কিন্তু মনের আনন্দে , প্রাণ খুলে গাইতে গাইতে দুফোঁটা জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল  | ছোট্ট বেলায় আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে নীলার | ছোটবেলার দিনগুলো কে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে নীলা |  বলছে ," যেতে নাহি দিব | হায় তবু চলে যায়\  চলিতেছে এমনি অনাদি কাল হতে  " | 

বয়স যত বাড়ছে  , শৈশবের সাথে দূরত্ব  যত  বাড়ছে  , ততই যেন মানুষ উদগ্রীব হয়ে উঠছে,  স্বপ্ন ভরানো ,ভালোবাসায় ভরানো শৈশবটাকে ধরে রাখবার জন্য  |  সকলের যেন প্রাণ মন কায় \ এক  খানি বাহু হয়ে ধরিবারে চায় , ফেলে আসা ছোটবেলাকে  |  প্রার্থনা শেষে হেডমিস্ট্রেস একটি ঘোষণা করলেন  , "সবাই দু  টাকা করে নিয়ে আসবে অবশ্যই "|  ছাত্রীরা সবাই সমস্বরে বল্লো,  হ্যাঁ বড়দি , নিয়ে আসব | 


  হেড মিস্ট্রেস নিজের রুমে নিয়ে বসালেন  নীলাকে | পরিচয় হল , কুশল বিনিময় হলো  |  কথাবার্তার মধ্যে অচিরেই সেই প্রসঙ্গ উঠলো , হঠাৎ দু  টাকা  কেন !! নীলার অবশ্য মনে পরল ওরাও কখনো কখনো 50 পয়সা করে কালেক্ট করত দুঃস্থ কোন ছাত্রীর ইউনিফর্মের খরচা বাবদ  |  এখনো সেই ট্রাডিশন চলছে  | ভালো  |   সেই যে মেয়েটি ছিল , অঞ্জলি  | নীলা ভাল ছাত্রী বলে নাম ছিল |   অঞ্জলি  তাই   নীলার গায়ে গায়ে লেপ্টে থাকতো | অঞ্জলি  হাসপাতালে ভর্তি হল   , টাইফয়েড  | প্রত্যেকের কাছ থেকে একটি করে টাকা তোলা হয়েছিল  | কিন্তু নাহ টাকাটা আর কাজে লাগলো না  | তার আগেই অঞ্জলি ঘুমিয়ে পড়ল | ঘুম অ্যার ভাঙল না |  হাসপাতালে যেদিন শেষ দেখা হয়েছিল তখনও  অঞ্জলীর চোখে বাঁচার স্বপ্ন  , মনে আশা  |   নীলা কে হাত ধরে বলেছিল  ,  তুই কিন্তু আমাকে পড়িয়ে  দিস  |  কত দিন স্কুলে যায়নি   | পাস তো করতেই হবে   |    

 

 কিন্তু    অঞ্জলি যে  জীবন যুদ্ধেই  হেরে গেল   !! আনেক দিন পর অঞ্জলির কথা মনে পড়ল |

  সেই দু টাকার ব্যাপারে বর্তমান বড়দি কিন্তু অন্যরকম কিছু বললেন |  রবি নাম শুনেই নীলার  চোখ চকচক করে উঠলো |  রবিকে কি ভোলা যায় !  এত বছর হয়ে গেছে  !  কি করে ভুলবে ! টানা   ছয় বছর নীলা স্কুলে ঢুকতে  বেরতে  যে সেই লোকটাকে দেখত |   কত বছর পর আবার রবির প্রসঙ্গ উঠলো  | বড়দি মহামায়া  রায় বললেন , রবি এখন তো চলৎক্ষম হীন |  কাজকর্ম করতে পারেনা | তুমিও নিশ্চয়ই খেয়েছ ওর ঠেলাগাড়ি  থেকে |

_________  হা|  কিন্তু  বয়স তো অনেক হলো | এখন  আর  কি কাজ ---! 

 _________ হ্যাঁ বয়স ত হয়েছে  |  তবে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা রবিকে  মানসিক এবং শারীরিক ভাবে অক্ষম                                             করে দিয়েছে| 

_________  দুর্ঘটনা !! 

 ___________  হ্যাঁ  | খুব দুঃখের | ওর ছেলে তোমাদের বড় শহরে মজুরের কাজ করতে গিয়েছিল  |  কোন এক কনস্ট্রাকশন কম্পানি  |  নাম  টা  মনে  পরছে না |   খুব খুশি হয়েছিল রবি | যাবার আগে  ছেলেকে নিয়ে আমার কাছে এসেছিল |  কিন্তু সেই সুখ কপালে সইল না  | দশ তলা   থেকে ছেলেটা পড়ে যায় !! 

___________  তাহলে তো আর   !!!    নীলা  আঁতকে ওঠে

___________  হ্যাঁ  |তবে  তেমন  কোনো কম্পেন্সেশন দেয়নি  ওরা | আমার কাছে খবর আসে |  আমি কি করে যে নিজেকে সামলেছি  !! কদিন আগেই যে ছেলেটাকে আশীর্বাদ করলাম  !! রক্তের সম্পর্ক নয় তবু আমার  যা অবস্থা গেছে  ! রবির কথা আর কি বলব  | সামান্য কিছু  টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে   | একটি জীবনের  দাম   এত কম  !   এরা ধনী অথচ কি   নির্দয়  |  অভাব তো নেই  | তবুও গরিব দের দিকে তাকিয়েও দেখে না |  সেও নাকি আবার  বাঙালি ভদ্রলোক   !  এরা কেমনতর হৃদয়হীন মানুষ  !   তবে হ্যা , একবার ওদের কাউকে হাতে পেলে অন্তত আমার স্কুলের ছাত্রীরা ছাড়বেনা   |  রবি ওদের সবার প্রিয় |  আচ্ছা এদের কি মানবিকতা বলে কিছুই নেই  !  কেবলমাত্র টাকাই আছে  ! এদের কি  পরিবার-পরিজন,   সন্তান,  কিছু নেই  |   রবি বহু পুরনো  | তুমিও নিশ্চয়ই ওর দোকানে খেয়েছ !


  নীলার মুখে  রঙিন প্রজাপতির মত যে হাসিটি উড়ে বেড়াচ্ছিল এতক্ষন  ,   হঠাৎই কেমন যেন  মিইয়ে গেল  ,  ফিকে হতে হতে একেবারে উধাও হয়ে গেল  |  নীলার মেয়ে তখন স্কুলের লাইব্রেরীতে বই নিয়ে ব্যস্ত  | নীলার  কপালের দুপাশে  শিরা  দুটো ফুলে উঠলো্‌  সারা মুখ ঘামে ছপছপ করছে   |  আবার সেই মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হল |  কি যে কষ্ট হয়   ! মাগো  ! একটু টেনশন হলেই এই ব্যাথাটা চাগিয়ে ওঠে |


দুটি টাকা 


"এই   রবি  আমাকে দে ,  রবি আমাকে দে  , আমি আগে এসেছি  , রবি দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ,  রবি আমি কিন্তু সব ভেঙ্গে ফেলবো ,  রবি বেল বাজল বলে ,  রবি  আজ    যদি তোর জন্য বকা খাই  না  দিদিমণির  কাছে !! তারপর দেখবি তোর ঠেলা গাড়ির  টায়ার পাংচার করে দেব  ! " 

      এতগুলো ছোট ছোট অবুঝ  মেয়ের  দাপাদাপি রবির মুখের সামনে ,  তবু রবি অস্থির হয়না , অধৈর্য হয় না   |  সবাইকে যার যার পছন্দের জিনিস টি  দেয় |  মাত্র আধ ঘণ্টা  চলে এই তুমুল  হট্টগল | রবিকে  চারিদিক থেকে যেন ভিমরুলের মত ছেঁকে ধরে  !  তারপর বেলটা বাজলেই নিমেষে একেবারে খালি হয়ে যায় |   রবি তখন বটগাছের তলায় বসে জিরিয়ে নেয় |  আবার স্কুল ছুটির সময় কিছু বিক্রি-বাট্টা হবে খন  | 

" মা সারদা বালিকা বিদ্যালয় " |  তারই সামনে এক কোণে রবি ওর ঠেলাগাড়ি নিয়েই বসে থাকে |  কি নেই ওরা গাড়িতে  !  পাকা তেতুল  ! চালতার আচার  ! পপিন্স  !লেবেঞ্চুস  | ডালমুট  ! ঝাল মুড়ি  !  শোনপাপড়ি ! লেড়ে বিস্কুট !  সবকিছু   কাচের বয়ামে  সাজানো থাকে |  স্কুলের অল্প বয়সী মেয়ে গুলো ওকে  ছেঁকে ধরে  | কেউ  রবির হাত থেকেই পায় , কেউবা ছোঁ মেরে হাত থেকে নিয়ে চলে যায় কোনও রকমে পয়সাটা দিয়ে |  কেউ কেউ আবার চোখ পাকিয়ে বলে ,  রবি এত ঝাল কেন দিয়েছিস  !  রবি হাসি হাসি মুখ করে আবার বানিয়ে দেয়  | ওদের দুষ্টুমি  রবির  চোখ এড়ায় না |  বছরের পর বছর এই কাজই করছে রবি  |  ভালোই লাগে |  সংসারটাও চলে যায় |

      রবি নজর করেছে , একটি মেয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকে |  মনে হয় নতুন |  সবার থেকে একটু আলাদা  | চেহারায় ধনী ঘরের ছাপ  |  পরিষ্কার ধবধবে ইউনিফর্ম |  মেয়েটি  দুই একবার  বার চেষ্টা করেছিল ভিড়ের মধ্যে ঢোকার ,   কিন্তু এমন দাপুটে হাতের কাছে হার মেনেছে   |  ওর মুখে একটা লজ্জা লজ্জা ভাব  |  তেমন সহজ হতে পারে না  |  রবি বোঝে  মেয়েটা সবার থেকে অন্যরকম বৈকি |   মোটেই দামাল নয় ,  দস্যিপনা ওর কম্ম নয় |

          রবি নিজেই জিজ্ঞেস করে ,   দিদি তোমার কি চাই  ?  নীলা বলে দেয় |  রবি ওর কাগজের তিনকোনা ঠোঙায়  করে  গুছিয়ে  রেখে দেয় , তারপর সুযোগ বুঝে,  দিদি এই নাও বলে হাতে গুজে দেয় |  রবি জানে এই  শান্তশিষ্ট মেয়ে টি  ওই ডাকাবুকো মেয়েদের সাথে পেরে উঠবে না মোটে |   

 রবি 50 বছরের মাঝবয়সী  |  তবে কাঁচাপাকা  চুলে  বয়সটা অনেক বেশি দেখায় |   তবুও ওই কচিকাঁচারা সবাই রবিকে  তুই-তোকারি করে  | কারো দ্বিধা হয় না |  রবির তাতে কোনো আপত্তি নেই,  বেশ ভালোই  লাগে |  ও যেন ওদের বন্ধু হয়ে যায়  |  

কিন্তু নীলা  পারেনা |  ওর বাড়ির শিক্ষাদিক্ষা ওকে   সবার থেকে একটু  অন্যরকম বানিয়েছে |  মা বলে , বড়দের তুই-তোকারি করবি না সে যেই হোক না কেন  !  মুচি মেথর হলেও না |  যে বয়সে বড় তাকে সবসময় সম্মান করে কথা কইবে  |  নীলা  রবিকে , রবিদা বলে ডাকে | রবির  চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে  | মনটা ভরে যায়  | 

           মাঝে মাঝে রবির ছেলে  চুপটি  করে বসে  থাকত    রবির  পাশে | নীলাকে দেখে কইতো ,  ওই মাইয়া ডা  বড় লোকের বেটি   |  নীলার  বড় লজ্জা করে |   নিজেকে সবার থেকে আড়াল করে রাখত  |  একদিন অবশ্য   রবিকে দেখে নীলা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল |   রাগে  চোখ লাল  , কপালের শিরা ফুলে উঠছে , ছুটে গিয়েছে রবি  | এই সা  হাত টেনেছে ! হাত একেবারে মটকে  দিয়েছিল লোকটর |   লোকটা নাকি এমনি এমনি রবির ছেলেকে এক থাপ্পড় মেরেছিল |  ব্যাস  ! আর যায় কোথায় !  সত্যি সন্তানের জন্য বাবা কি না করতে পারে   !  রবি সব ভুলে গিয়ে লোকটার হাত কট করে মটকে দিল  |   একেবারে রিভেঞ্জ   !  রবির   সেই  রুদ্রমূর্তি এখনো নীলার  চোখে স্পষ্ট  |   বাপরে এত রাগ রবির !!    না দেখলে বুঝাই যায়না  , ভাবাই যায় না| 

 ,

            দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর আবার সেই স্কুলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে নীলা  |  স্কুল ছাড়ার পর কলেজ  | তারপর বিয়ে |   খুব শিগগিরই বিয়ে হয়ে গেছিল  | বরের হাত  ধরে দূরে ,  দূরে, অনেক দূরে চলে গিয়েছে |  এখানে,  সেই ছোটবেলার জায়গায় আর ফিরে আসা হয়নি | দুম  করেই বিয়েটা হয়ে গেল  | ইচ্ছে ছিল বিয়ের আগে একবার স্কুলে এসে ঘুরে যাবে কিন্তু তাড়াহুড়োয় সে আর  হয়ে  ওঠেনি |   বড়  দিদিমণি অবশ্য ওকে আশীর্বাদ জানিয়েছিল   |  লিখেছিলো,  " সারা পৃথিবীতে ডানা মেলে উড়ে বেড়াও,  খুব সুখী হও   | তোমার ঝকঝকে পরিষ্কার স্বচ্ছ মনটা যেন ঠিক একই রকম থাকে  | সত্য পথ ছেড়ো না  | " আজও সেই চিঠি যত্ন করে বিয়ের অ্যালবামে রেখে দিয়েছে নীলা | পঁচিশ  টি বছর পরে , এই ছোট্ট পাড়া গাঁ জন্মভূমিতে এসেছে নীলা | ইচ্ছে ছিল একবার স্কুলটাকে প্রণাম করে যাবে,  কারণ স্কুল নীলার  কাছে ঠিক যেন মন্দির , তীর্থক্ষেত্র | 


       মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে  নীলা |  ঝাঁ চকচক করছে ওর  "সারদা বালিকা বিদ্যালয়  " | স্কুল এখন তিনতলা হয়েছে  | চারিদিকে সাজান গোছানো গাছের সারি |  সামনে পেল্লাই গেট  | প্রাচীর  | আগে তো এতসব কিছু ছিল না  | বোঝাই যাচ্ছে স্কুলের অনেক উন্নতি হয়েছে , স্কুলের জৌলুস বেড়েছে  |   নীলা খবর পায় , এই স্কুল থেকে নাকি এখন বোর্ডে স্ট্যান্ড করে  !!   গর্বে মনটা ভরে যায় নীলার |

     মেয়েকে নিয়ে  ঢুকলো স্কুলে | সে ---- ই সেদিনের দিনগুলো চোখের সামনে ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে লাগল |  প্রথম যেদিন এসেছিল  ক্লাস সেভেন এ , সেদিন ছোট্ট একটি গেট দিয়ে ঢুকে ছিল |  স্কুলে ঢুকে  ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল  ! কেমন  হবে  দিদিমণিরা   !  ও তো নতুন এসেছে !!   ক্লাস এর মেয়েরা কেমন হবে !  আজ কিন্তু মোটেও ভয় নেই  নীলার  | আজ শুধু আনন্দ আর অদ্ভূত এক শিহরণ |  

           নীলা অফিস এ  জানাতেই ,  কেউ একজন গিয়ে হেডমিস্ট্রেস কে খবর দিলো  |  প্রাক্তন ছাত্রী এসেছে শুনে  হেডমিস্ট্রেস  নিজেই এগিয়ে এলেন |  সাদরে নিয়ে গেলেন ভেতরে  | ততক্ষণ প্রার্থনার জন্য  ছাত্রীরা তৈরি  | খুব ভালো সময়ে  এসেছে |  স্কুলের সেই মাঠ   ! সেই চৌকো মাঠ এখনো একই রকম আছে বরং জৌলুস যেন আরও বেড়েছে  | চারিদিকে সবুজ | মনে পড়ল  ওরা একবার পনরই আগস্ট এ বৃক্ষরোপণ  করেছিল | আহা সেই গাছ গুলোই  বুঝি বড় হয়ে স্কুল কে একেবারে সবুজে  ভরিয়ে দিয়েছে | 

    স্কুলের প্রত্যেকটি ছাত্রী মাঠে ঠিক সে --ই রকম লাইন করে দাঁড়িয়েছে  |  প্রার্থনার জন্য সবাই হাত জোড় করে আছে | |  সবার সাথে  নীলাও দাঁড়িয়ে পড়ল |  দুই হাত জোড় করে গাইল , "আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণও ধুলার পরে "| 

      নীলা র মনে পরল সেই সময় নীলার  সাথে থাকতো শ্রাবণী ,  দুর্গা , চুমকি , শুক্লা,  গার্গী,  মৈত্রী  , কেকা | সবাই একসাথে লাইন করে ক্লাস থেকে আসত |   ওরা ভারি  দুষ্টু ছিল  !!  কেউ গাইতো না  |  চোখ মিটমিট করত আর ঠোঁট দুটো একটু নাড়াত |   ক্লাস টিচার  কস্তূরী দি সব বুঝতে পারতেন  |  পেছন থেকে এসে মাথায় এক গাট্টা মারত |  সবাই একসাথে চেঁচিয়ে উঠতো  "আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণও ধুলার পরে  " | নীলাও বাদ যেত না |  তখন সবার সাথে শুরু করতো একই সুর | আজ অ্যার মাথায় গাট্টা দেবার কেউ নেই !! আজ নিজেই প্রাণভরে  গাইল |


 আজ কিন্তু মনের আনন্দে , প্রাণ খুলে গাইতে গাইতে দুফোঁটা জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল  | ছোট্ট বেলায় আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে নীলার | ছোটবেলার দিনগুলো কে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে নীলা |  বলছে ," যেতে নাহি দিব | হায় তবু চলে যায়\  চলিতেছে এমনি অনাদি কাল হতে  " | 

বয়স যত বাড়ছে  , শৈশবের সাথে দূরত্ব  যত  বাড়ছে  , ততই যেন মানুষ উদগ্রীব হয়ে উঠছে,  স্বপ্ন ভরানো ,ভালোবাসায় ভরানো শৈশবটাকে ধরে রাখবার জন্য  |  সকলের যেন প্রাণ মন কায় \ এক  খানি বাহু হয়ে ধরিবারে চায় , ফেলে আসা ছোটবেলাকে  |  প্রার্থনা শেষে হেডমিস্ট্রেস একটি ঘোষণা করলেন  , "সবাই দু  টাকা করে নিয়ে আসবে অবশ্যই "|  ছাত্রীরা সবাই সমস্বরে বল্লো,  হ্যাঁ বড়দি , নিয়ে আসব | 


  হেড মিস্ট্রেস নিজের রুমে নিয়ে বসালেন  নীলাকে | পরিচয় হল , কুশল বিনিময় হলো  |  কথাবার্তার মধ্যে অচিরেই সেই প্রসঙ্গ উঠলো , হঠাৎ দু  টাকা  কেন !! নীলার অবশ্য মনে পরল ওরাও কখনো কখনো 50 পয়সা করে কালেক্ট করত দুঃস্থ কোন ছাত্রীর ইউনিফর্মের খরচা বাবদ  |  এখনো সেই ট্রাডিশন চলছে  | ভালো  |   সেই যে মেয়েটি ছিল , অঞ্জলি  | নীলা ভাল ছাত্রী বলে নাম ছিল |   অঞ্জলি  তাই   নীলার গায়ে গায়ে লেপ্টে থাকতো | অঞ্জলি  হাসপাতালে ভর্তি হল   , টাইফয়েড  | প্রত্যেকের কাছ থেকে একটি করে টাকা তোলা হয়েছিল  | কিন্তু নাহ টাকাটা আর কাজে লাগলো না  | তার আগেই অঞ্জলি ঘুমিয়ে পড়ল | ঘুম অ্যার ভাঙল না |  হাসপাতালে যেদিন শেষ দেখা হয়েছিল তখনও  অঞ্জলীর চোখে বাঁচার স্বপ্ন  , মনে আশা  |   নীলা কে হাত ধরে বলেছিল  ,  তুই কিন্তু আমাকে পড়িয়ে  দিস  |  কত দিন স্কুলে যায়নি   | পাস তো করতেই হবে   |    

 

 কিন্তু    অঞ্জলি যে  জীবন যুদ্ধেই  হেরে গেল   !! আনেক দিন পর অঞ্জলির কথা মনে পড়ল |

  সেই দু টাকার ব্যাপারে বর্তমান বড়দি কিন্তু অন্যরকম কিছু বললেন |  রবি নাম শুনেই নীলার  চোখ চকচক করে উঠলো |  রবিকে কি ভোলা যায় !  এত বছর হয়ে গেছে  !  কি করে ভুলবে ! টানা   ছয় বছর নীলা স্কুলে ঢুকতে  বেরতে  যে সেই লোকটাকে দেখত |   কত বছর পর আবার রবির প্রসঙ্গ উঠলো  | বড়দি মহামায়া  রায় বললেন , রবি এখন তো চলৎক্ষম হীন |  কাজকর্ম করতে পারেনা | তুমিও নিশ্চয়ই খেয়েছ ওর ঠেলাগাড়ি  থেকে |

_________  হা|  কিন্তু  বয়স তো অনেক হলো | এখন  আর  কি কাজ ---! 

 _________ হ্যাঁ বয়স ত হয়েছে  |  তবে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা রবিকে  মানসিক এবং শারীরিক ভাবে অক্ষম                                             করে দিয়েছে| 

_________  দুর্ঘটনা !! 

 ___________  হ্যাঁ  | খুব দুঃখের | ওর ছেলে তোমাদের বড় শহরে মজুরের কাজ করতে গিয়েছিল  |  কোন এক কনস্ট্রাকশন কম্পানি  |  নাম  টা  মনে  পরছে না |   খুব খুশি হয়েছিল রবি | যাবার আগে  ছেলেকে নিয়ে আমার কাছে এসেছিল |  কিন্তু সেই সুখ কপালে সইল না  | দশ তলা   থেকে ছেলেটা পড়ে যায় !! 

___________  তাহলে তো আর   !!!    নীলা  আঁতকে ওঠে

___________  হ্যাঁ  |তবে  তেমন  কোনো কম্পেন্সেশন দেয়নি  ওরা | আমার কাছে খবর আসে |  আমি কি করে যে নিজেকে সামলেছি  !! কদিন আগেই যে ছেলেটাকে আশীর্বাদ করলাম  !! রক্তের সম্পর্ক নয় তবু আমার  যা অবস্থা গেছে  ! রবির কথা আর কি বলব  | সামান্য কিছু  টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে   | একটি জীবনের  দাম   এত কম  !   এরা ধনী অথচ কি   নির্দয়  |  অভাব তো নেই  | তবুও গরিব দের দিকে তাকিয়েও দেখে না |  সেও নাকি আবার  বাঙালি ভদ্রলোক   !  এরা কেমনতর হৃদয়হীন মানুষ  !   তবে হ্যা , একবার ওদের কাউকে হাতে পেলে অন্তত আমার স্কুলের ছাত্রীরা ছাড়বেনা   |  রবি ওদের সবার প্রিয় |  আচ্ছা এদের কি মানবিকতা বলে কিছুই নেই  !  কেবলমাত্র টাকাই আছে  ! এদের কি  পরিবার-পরিজন,   সন্তান,  কিছু নেই  |   রবি বহু পুরনো  | তুমিও নিশ্চয়ই ওর দোকানে খেয়েছ !


  নীলার মুখে  রঙিন প্রজাপতির মত যে হাসিটি উড়ে বেড়াচ্ছিল এতক্ষন  ,   হঠাৎই কেমন যেন  মিইয়ে গেল  ,  ফিকে হতে হতে একেবারে উধাও হয়ে গেল  |  নীলার মেয়ে তখন স্কুলের লাইব্রেরীতে বই নিয়ে ব্যস্ত  | নীলার  কপালের দুপাশে  শিরা  দুটো ফুলে উঠলো্‌  সারা মুখ ঘামে ছপছপ করছে   |  আবার সেই মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হল |  কি যে কষ্ট হয়   ! মাগো  ! একটু টেনশন হলেই এই ব্যাথাটা চাগিয়ে ওঠে |


 আর  দেরী করল না |     স্কুল থেকে বেরিয়ে এল মেয়ের হাত ধরে |  নাহ , রবিকে  একবার দেখেই যাবে  |  স্কুলের পাশেই এক কোনায় পড়ে আছে ঠেলাগাড়ি   , তার ওপর শুয়ে আছে এক জীর্ণশীর্ণ হাড়জিরজিরে বুড়ো |   মুখ ভর্তি দাড়ি  |  নীলা হতভম্বের  মতো দাড়িয়ে রইল |  কোথায় চলে গেল  মনটা | হারিয়ে গেল সে---- ই দিনগুলোতে |  রবির একমুখ হাসি ,  হাতদুটো মেশিনের মতো চলছে,  ঠোঙা বানাচ্ছে,   ভরছে , দিচ্ছে  | চারিদিকে সবাই চেঁচাচ্ছে রবি আমাকে দে ,  রবি আমাকে  , রবি দে  , তোর দোকান ভেঙে ফেলব আমাকে দাড় করিয়ে রেখেছিস  ,  রবি বেল বাজল   , আমাকে দিলি না আমি কিন্তু নিজের হাতেই নিয়ে নিলাম , বেশি বেশি নিলাম  ! 

      হাতে একটা  আলতো ধাক্কা খেলো নীলা |  মেয়ের ডাকে হুঁশ ফিরল  | মেয়ে ডেকে  উঠল  ,  মা মা  | নীলা  চমকে উঠলো  | রবিদা  কাঁপা কাঁপা গলায় বলল , কি চাই দিদিরা !! 

 বুকের ভেতর  কেঁপে  উঠল নীলার |   চিনতে পেরেছে  ?  রবি চিনতে পেরেছে ?  কিন্তু রবি দাকে কিছুতেই  জানতে দেওয়া যাবে না   নীলা  কোথায় থাকে  ,  কোথা থেকে এসেছে   |  ছি ছি   ! তবে যে আর মুখ দেখাবার জো থাকবে না | কি উত্তর দেবে তখন নীলা , যখন রবিদা বলবে তোমাদের শহরে গিয়াই তো আমার ছেলেটা মরল !!

        ব্যাগ থেকে একটা হাজার টাকার নোট বের করল নীলা  | এগিয়ে দিল  |  বৃদ্ধ  টাকার দিকে তাকিয়ে দেখল , ,মুখে একটা  হাসি নিয়ে বলল ,  " আমাকে কেন টাকা দিচ্ছ না চাইতেই  ,  আমিতো ভিখারি নই গো  | তোমরা বড়লোকের বেটিরা স--ব পারো  | ভালোবাসতে পারো  | তবে টাকার বিনিময়ে ভালবাসাটা বড় সস্তা করে ফেলো  | আবার মরণকে নিত্যদিনের তুচ্ছ ছেলেখেলা বলে মনে করো  | আমার স্কুলের মেয়েরা দু টাকা করে দিচ্ছে আমাকে  | সেটাই অনেক বেশি   | কি হবে অত টাকা দিয়ে  !  দুইবেলা পেটে দুটো পরলেই হয় | বাঁচার  আর  ইচ্ছা নাই গো দিদিরা ! তয়  উপরওয়ালা না নিলে কি করুম !! তাই দুটা ভাত পেটে পরলেই ,  আর  কিছু চাই না | দুটো টাকা থাকলে , দাও দিদিভাই | " 

 

 কিন্তু নীলার কাছে যে দু টাকার কয়েন নেই | বড় বড় নোটে ব্যাগ ভর্তি |  রবিদার কথা শুনে  নীলার  পায়ের তলায় মাটি টা দুলে উঠল  | তবে  কি   রবিদা চিনতে পেরেছে  ? আর দেরী করলো না  | নীলা  মেয়ের হাত  ধরে গাড়ির   দিকে এগিয়ে গেল  |  দুই হাতে মেয়েকে চেপে ধরে ঢুকিয়ে দিল  |  এক অজানা ভয়ে কেঁপে উঠল নীলা  |  মেয়ের  মুখের দিকে একবার তাকালো , মাথাটা নিজের বুকে ঠেসে ধরল  |  বহু বছর আগে  রবির রুদ্রমূর্তি ওর চোখের সামনে ভেসে উঠলো  |  কি ভয়ংকর  !! ড্রাইভারকে বললো  , গাড়ি চালাও জলদি |


 নিজের ঝাঁ চক  চকে  কসমোপলিটান শহরে  ফিরে এলো  |  তৃষিত এর সাথে  গল্প হল |  সেই  ,ছোটবেলা | সেই    কৈশোর , যৌবনের  এর জায়গা , আত্মীয় স্বজন , বন্ধু বান্ধব , স্কুল , তোর্সা  নদী , রাজবাড়ি  --------- অনেক গল্প হল  | কিন্তু রবির গল্প হল না |  

           নীলা জানে  রবির গল্প করলে  তৃষিত  কি বলবে  !! তৃষিত  চেঁচিয়ে উঠবে , বলবে , ছাড়ো তোমার সমাজসেবা   | আমাদের কনস্ট্রাকশনে রোজ  কতগুলো করে মরছে   | কতজনকে টাকা দেব ?  কম্পেন্সেশন দেব  ? এরা আসে কেন মরতে  !!  ওই ছেলেটার  ,   ওটাতো সুইসাইড বলে চালিয়ে দিয়েছি  | তাও কিছু টাকা  তো দিয়েছি | অত ভাবলে কোম্পানিতে লাল বাতি জ্বলবে |  যতসব গেঁয়ো  ভূত   !  অকর্মের ঢেঁকি'   | কাজকর্ম কিছু পারেনা   ! পড়ে মরে আর তার দায় কোম্পানির  |   রাস্তা ঘাটে রোজ কত লোক মরে পড়ে থাকে |  কে খোঁজ  রাখে !! এ নিয়ে সময় নষ্ট করার সময় আমার নেই নীলা | 

 তারপরই   তৃষিত   দুই হাতে জড়িয়ে ধরবে  নীলাকে ,  হাসবে ,   আদরে আদরে ভরিয়ে দেবে  |  বলবে,  জানো এখন ফ্ল্যাটগুলো দেড় কোটি যাচ্ছে   ! হুহু করে দাম বাড়ছে |  শোনো   ,  আমাদের বেবিকে আমার কোম্পানির সিইও করব |এখন   থেকেই  তৈরি করতে হবে বেবি  কে | 


 একা ঘরে নীলা |  মেয়ে স্কুল || মনটা মাঝে মাঝেই হু  হু  করে উঠছে |   একটা দু টাকার নোট আতিপাতি করে খুঁজে বেরাল নীলা |  কিন্তু পেল না  |একটা দু টাকার নোট  বা  কয়েন  আজ বড় দরকার   |  মাত্র  দুই টাকার নোট কিংবা কয়েনে এতো ভালোবাসা এতো সম্মান থাকে !!  নীলা জানতো না   | সারাবাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজল |   আলমারির ড্রয়ার,  সাইড ব্যাগ,  মানিব্যাগ, আনাচ কানাচ |  কেউ কি দেবে নীলাকে  একটি দুই টাকার কয়েন  !   নীলা যে  আজ মাত্র  দুটি  টাকার  কাঙাল |  কেউ যদি দিত নীলা সাগ্রহে অঞ্জলি পেতে নিত   |  ওর দেবতার পূজায়  যে দুটি মাত্র টাকা  লাগে |     মাত্র  দু  টাকাতেই সম্পূর্ণ    পূজো | 


No comments

FACEBOOK COMMENT